Advertisement

কাজী নজরুল ইসলাম


                 কবি কাজী নজরুল ইসলাম

     

‘বল বীর-বল উন্নত মম শির!শির নেহারি’ আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির!বল বীর'বাংলা সাহিত্যের প্রথম বলিষ্ঠ কবি কণ্ঠস্বর আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র প্রতিভার মধ্যে থেকেই সমাজের শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বলদীপ্ত উচ্চারণ তাঁরই। একথা না মেনে উপায় নেই যে, সত্যেন্দ্রনাথ, মোহিতলাল ও যতীন্দ্রনাথ নজরুল ইসলামের পূর্বসূরী হলেও তাঁর কাব্যই প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের হতাশা-নৈরাশ্য, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিদ্রোহ বিক্ষোভের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। সেদিক থেকে নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহ, পৌরুষ ও যৌবনের অগ্রগণ্য ভাষাকারদের মধ্যে অন্যতম বলা যায়।


জন্ম ও পরিচয়: কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জৈষ্ঠ্য) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। তার পিতা কাজী ফকির আহমদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন।


বিবাহ এবং সন্তান-সন্ততি: তিনি সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমকে প্রথমে বিয়ে করেন ১৯২১ সালে। কিন্তু কবির সাথে কবি পত্নীর মনোমালিন্যের কারণে তাদের একত্রে বসবাস করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন প্রমীলা দেবী'কে (আশালতা সেনগুপ্তা)। তাঁর প্রথম পুত্র বুলবুল এবং অন্য দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ ।


ছেলেবেলা: কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার প্রথম থেকেই ছিল আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট। তাঁর ছেলেবেলা পুরোটাই কেটেছে সীমাহীন দারিদ্র্র্যে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েন। অভিভাবকহীনতায় তিনি হয়ে উঠেন উচ্ছৃঙ্খল, অর্থ সংকটের কারণে যুদ্ধে যোগ দেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছোটবেলায় ‘দুখু মিয়া’ নামেও পরিচিত ছিলেন।


শিক্ষা ও কর্মজীবন: গ্রামের মক্তব থেকে তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরবর্তীতে বর্ধমানে একটি হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলে চলে যান। এখানেও তিনি আর্থিক দুরাবস্তার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পরে তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন, এছাড়াও তিনি মাংসের দোকানে ও রুটির দোকানে কয়েক টাকা বেতনে চাকরি করেন। অতঃপর তিনি শিয়ারশোল হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা নির্বাচনী পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং এখানেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবসান ঘটে। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি ১৯১৭ সালে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগদান করেছিলেন সৈনিক পদে, পরে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এই পদ থেকে তিনি ছাটাইও হন। পরবর্তীতে তাকে ঐ অর্থে কোনো চাকরি করতে দেখা যায়নি, লেখালেখি, বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা প্রভৃতি করে এক প্রকার আর্থিক দৈন্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন।


সাহিত্যের ধারা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যিকগণ যেমন বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র ধারার লেখক, কাজী নজরুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি তাঁর লেখনীতে একই সাথে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, বিদ্রোহ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শাশ্বত প্রেম প্রভৃতির এমন সম্মিলন ঘটিয়েছেন যা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। এজন্য তিনি বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।


বিদ্রোহী নজরুল: বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব বিশেষত ঔপনিবেশিক শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে প্রবল ঝড়ের মতো। তাঁর রচিত কবিতা, গান, প্রবন্ধ, পত্রিকার নিবন্ধ প্রভৃতিতে কবির বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন তিনি ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলেছেন-


‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্তআমি সেই দিন হব শান্ত,যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে নাঅত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে নাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্তআমি সেই দিন হব শান্ত।


প্রেমিক নজরুল: দোলন চাঁপা, ছায়ানট, পূবের হাওয়া, সিন্ধু-হিল্লোল ও চক্রবাকের মধ্যে কবির প্রেমিক সত্ত্বারই পরিচয় ফুটে ওঠেছে। ‘চক্রবাক’ কাব্যের উৎসর্গ পত্রে বলেছেন-


‘ওগো ও চক্রবাকীতোমারে খুঁজিয়া অন্ধ হলো যে চক্রবাকের আখি!’তিনি যেমন এক হাতে বিদ্রোহের কবিতা লিখেছেন, অন্য হাতে লিখেছেন প্রেমের কবিতা। বিদ্রোহ ও প্রেমকে তিনি একই সাথে বেঁধেছেন অসীম দক্ষতার ছলে, বলেছেন ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণ-তূর্য’।


সাম্য ও মানবতাবাদী নজরুল: নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। ১৯২৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন- কান্ডারী হুশিয়ার, পথের দিশা, হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ প্রভৃতি কবিতা। কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতায় বলেছেন-


‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনো জন?কান্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’অন্যদিকে নজরুল ইসলামকে বলা হয় সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তিনি হিন্দু-মুসলিম, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখেছেন। ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি বলেছেনগাহি সাম্যের গানমানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!তিনি যেমন মানবতার গান গেয়েছেন তেমনি সমাজে নারী-পুরুষের সমান অবস্থানে কথাও


বলেছেন। নজরুল ইসলাম জানতেন মানব সমাজের উন্নতিকল্পে তাঁরা একে অপরের সাথে জড়িত। তিনি ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন-


‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।’


নজরুল রচনাবলী: কবি হিসেবে নজরুল ইসলাম সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তার দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রচিত অনান্য সৃষ্টিকর্ম -


কাব্য: অগ্নি-বীণা, দোঁলনচাপা, বিষের বাঁশি, পুবের হাওয়া, সাম্যবাদী।


জীবনীমূলক কাব্য: চিত্তনামা, সর্বহারা, ভাঙার গান, ফণি-মনসা, সিন্ধু-হিল্লোল, প্রলয়-শিখা, জিঞ্জির, শেষ সওগাত, সন্ধ্যা, চক্রবাক, নতুন চাঁদ, সঞ্চিতা, মরু-ভাস্কর, ঝড়।


কিশোর কাব্য: ঝিঙে ফুল, সাত ভাই চম্পা।


উপন্যাস: বাঁধন হারা, কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধা।


গল্পগ্রন্থ: ব্যাথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা।


নাটক: ঝিলিমিলি, আলেয়া, মধুমালা।


প্রবন্ধগ্রন্থ: যুগবাণী, রুদ্রমঙ্গল, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, ধুমকেতু।


কাব্যানুবাদ: রুবাইয়াত-ই-হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, কাব্যে আমপারা।


চিত্রকাহিনী: বিদ্যাপতি, সাপুড়ে।


পত্রিকা সম্পাদনা: নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙল।


একই সঙ্গে অবিরাম ধারায় তিনি লিখেছেন গজল গান আর শ্যামাসঙ্গীত।


গ্রেফতার ও কারাবাস: নজরুল ইসলাম ইংরেজ তথা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, তাদের অন্যায়, অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরেছিলেন। এজন্য তাকে অনেক ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। ১৯২২ সালে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এবং ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ নামক কবিতা প্রকাশের জন্য তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার করে তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় পাঠানো হয় এবং ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু জেলেও তিনি তাঁর লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। তাঁর ৬টি বই সেই সময়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়।


পুরস্কার: তাঁর লেখা যেমন অব্যাহত ছিল তেমনি তিনি সাফল্যও অর্জন করেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান জগত্তারিনী স্বর্ণপদক (১৯৪৫)। এছাড়াও ভারত সরকার থেকে পদ্মভূষণ (১৯৬০), রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট (১৯৬৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট (১৯৭৪) এবং বাংলাদেশ সরকার থেকে একুশে পদক (১৯৭৬) লাভ করেন।


অন্তিম যাত্রা: ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম পিকস ডিজিজ নামক মস্তিষ্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩) ঢাকায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।


কাজী নজরুল ইসলামের কবিসত্ত্বায় বিচিত্রতার সমাবেশ সত্যিই মোহিত হওয়ার মতো। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জল নক্ষত্র। তাঁর লেখনিতে যেমন উঠে এসেছে প্রেম-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট তেমনি বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে বলিষ্ঠ ভাষায়। সাহিত্যেও প্রতিটি শাখায় তাঁর বিচরণ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।