Advertisement

সুন্দর করে নবীজির জীবনী লিখতে পারতেন

একটি গল্প আছে। একবার এক বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের সাথে একজন মাওলানার দেখা হলো। মাওলানা সাহেবের বহুদিনের শখ ছিল হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করার। মাওলানা সাহেব অনুরোধ করে হুমায়ূন আহমেদকে বললেন আপনার লেখা সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়ে। আপনি যদি আমাদের নবীজি(সা.) এর জীবনী লিখতেন তাহলে বহু লোক তা আগ্রহ করে পড়তো।

সুন্দর করে নবীজির জীবনী

আপনি খুব সুন্দর করে নবীজির জীবনী লিখতে পারতেন।" হুমায়ূন আহমেদ চমকালেন। উনার মনে হলো, সত্যিই তো! এতকিছু লিখেছি জীবনে। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ে কেন লিখলাম না? অবশ্যই লেখা উচিত। উনি জানালেন, "ভাই, আপনার কথাটা আমার ভালো লেগেছে। আমি নবী করিমের জীবনী লিখবো।"তিনি ঠিক করে ফেললেন যে তিনি মহানবী(সা.) এর জীবনী লিখবেন।

লিখতেই হবে। নইলে লেখক জীবন পূর্ণতা পাবে না। এ নিয়ে উনার চিন্তারও শেষ নেই। কারণ চট করে তো আর জীবনী লিখে ফেলা যায় না। তাও আবার মহামানবের,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবের জীবনী। এই লেখার ভার অত্যন্ত গুরুভার। খুব মনোযোগের সাথে লিখতে হবে। এই লেখার সময়ে এক ফোঁটা মনোযোগ যেন অন্য কোনো দিকে না যায়। যেন কোনো ভুল না হয়ে যায়। তিনি বইটির নাম ঠিক করলেন "নবীজি।

 হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্মে খুব সচেতনভাবেই ইসলাম ধর্মকে উপস্থাপনের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। রাজাকার মানেই দাড়ি টুপি এমন কিছু হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো ছবিতে দেখা যায় না।শ্যামল ছায়া" উপন্যাসে মাওলানা চরিত্রের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন প্রকৃত ইসলামের রূপ। শেষের দিকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে মাওলানা সাহেব মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নিকট গিয়ে বললেন,জনাব, আমি আপনাদের সাথে যুদ্ধে যেতে চাই।

 প্রকৃত মুসলমান জালিমের

 আমার স্ত্রী আমাকে অনুমতি দিয়েছেন।"কমান্ডার সাহেব প্রশ্ন জি জনাব। প্রকৃত মুসলমান জালিমের শাসণে থাকে না।"কমান্ডার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রী তো অন্তঃসত্ত্বা। উনাকে দেখবে কে?"মাওলানা সাহেব আকাশের দিকে দু'হাত তুলে বললেন, আল্লাহ পাক দেখবেন।"মাহফুজ আহমেদ লিখিত সাক্ষাৎকারভিত্তিক 'ঘরে বাইরে হুমায়ূন আহমেদের হাজার প্রশ্ন' বইয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন,আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে।

যাঁরা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার না। এরা কেন জানি ইসলাম ধর্মকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অন্য যেকোনো ধর্মের প্রায় সব উৎসবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেন, বক্তৃতা করেন, বাণী দেন- কিন্তু ইসলামি কোনো জলসায় কেউ উপস্থিত থেকেছেন বলে শোনা যায় না। তাদের মতে, ইসলামি জলসায় কেউ উপস্থিত থাকা মানে তার বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নমানের। সে একজন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক লোক।

 আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অর্থ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, প্রগতির চর্চা করা, সংস্কারমুক্ত হওয়া ইত্যাদি।নোবেলজয়ী প্রফেসর সালাম ঢাকায় এসে যখন বক্তৃতার শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' বললেন, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা হকচকিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে প্রগতিশীল হওয়া, বুদ্ধিজীবী হওয়া, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানেই ইসলামবিরোধী হতে হবে।

 তারা উদাহরণ হিসেবেও

 তাদের কাছে রামকৃষ্ণের বাণী, যিশুর বাণী সবই গ্রহণীয়। এসব তারা উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করেন; কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বাণী কখনো তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না।আমার মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঔপন্যাসিক যাঁর কোটের পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর নাম দস্তয়ভস্কি। আরেকজন আছেন মহামতি টলস্টয়। এক রেলস্টেশনে যখন টলস্টয় মারা গেলেন, তখন তাঁর ওভারকোটের পকেটে।

একটি বই পাওয়া গেছে। বইটি ছিল টলস্টয়ের খুব প্রিয়। সব সময় সঙ্গে রাখতেন। সময় পেলেই পড়তেন। বইটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর বিভিন্ন সময়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে গ্রন্থিত।আমি বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাইছি, আপনাদের ক'জন বইটি পড়েছেন? টলস্টয় যে বইটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেই বই আমাদের প্রত্যেকের একবার কি পড়া উচিত নয়? আমার মতে, প্রতিটি শিক্ষিত ছেলেমেয়ের বইটি পড়া উচিত।



যাই হোক, মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে গিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদ নবীজি বইটি লিখতে শুরু করলেন। প্রথম পাতায় তিনি লিখলেন,সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবীজির কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা। ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময় মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে। তিনি তো ক্ষমা করার জন্যেই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবীজি (সা.) এর কাছেও।

প্রথমে তিনিলিখলেন হযরত

উনার কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর।"জীবনী লেখা শুরু হলো। প্রথমে তিনিলিখলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের আগে আরবের অবস্থার কথা। এবং তা বর্ণনা করার জন্য তিনি ব্যবহার করলেন পবিত্র কুরআনের সূরা তাকবিরের একটি আয়াতের মর্মার্থ,সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণ গর্ভা উষ্ট্রী উপেক্ষিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে।

যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে যখন আত্মা পুনঃসংযোজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাস করা হবে- কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?"সম্পূর্ণ জীবনী উনি লিখতে পারেন নি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের পর তাঁকে লালন পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুধমাতা হালিমা(রা.) এর নিকট। হালিমা(রা.) এর এক কন্যা সারাদিন চন্দ্রশিশু কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন হালিমা(রা.) রেগে।

গিয়ে কন্যাকে বললেন,তুমি সারাদিন বাচ্চাটাকে নিয়ে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াও। ওর কষ্ট হয় না?"উনার কন্যা উত্তরে বলেছিলে আমার এই ভাইটার মোটেও কষ্ট হয় না, মা। আমি ওকে নিয়ে যেখানেই যাই সেখানেই একগুচ্ছ মেঘ এসে আমাদের মাথার উপরে থেমে গিয়ে ছায়া দেয়।এই পর্যন্তই হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন। তারপর তিনি আক্রান্ত হলেন কর্কট রোগে। এত উৎসাহ নিয়ে শুরু করা বই "নবীজি" আর শেষ করা হলো না।

.