Advertisement

প্রস্তাব বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও পায় না আর


আমার জন্য সরকারী চাকুরীজীবি পাত্রের অভাব হয়নি।বয়স আঠারো পেরুবার আগেই শহরের এক স্বচ্ছল পরিবার থেকে প্রস্তাব আসে। দেনা পাওনা খুব একটা ছিল না ওদের।১৮ হয়নি বলে বাবার একটু অমত থাকলেও আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শীদের পরামর্শে মানা করতে পারেননি। এমন প্রস্তাব বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও পায় না আর সেটা তো আমাদের ঘরে নিজে পায়ে হেটে এসেছে।

আমার পরে আরও দু দুটো বোন

হ্যা মেয়ের একটু রূপ আছে বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।আমাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়ের মতামতকে খুব একটা গণ্য করা হয় না বললেই চলে। আমার পরে আরও দু দুটো বোন এরপর একটা ভাই সবার ছোট। গ্রামের ভেতরে ছোট্ট একদম ছোট্ট একটা দোকান ঝুপরির মত সেখানে বাবা পান বিক্রি করেন সাথে মাঝে মাঝে চা।ছেলের পরিবার আমাকে দেখতে আসলে বাবা উনার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন।ছেলেপক্ষের এসবে কোন অভিযোগ ছিল না। উনারা শুধু একটা সংসারী মেয়ে চান। 

যে সংসারকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখবে। তাদের কথাবার্তা শুনে আমার পরিবার খুশি আমিও মনে মনে খুশি হলাম।আমার ফুপু নির্ভয়ে আশ্বাস দেন 'আমার এই মেয়ের মত লক্ষ্মী মেয়ে পাওয়া ভার আশা করি নিরাশ হবেন না।'তখন আমি মাত্র একাদশে। আমাকে বিয়ে দেওয়া হবে৷ এই একাদশ অব্দি আসতে আমার কত বাঁধা বিপত্তি পেড়িয়ে এসেছি তা শুধু আমিই জানি। বাবা মাকে মুখ ফোটে কিছু চাওয়ার মত কিছুই ছিল না আমার।

শুধু একবার বললাম, উনারা যদি আমাকে ইন্টার পরিক্ষাটা দেওয়ার সুযোগ দিতেন!উনারা এই বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলে দেখবেন এতটুকু আশ্বাস দিলেন আমায়। কিন্তু কতটুকু সুযোগ পাব তার নিশ্চয়তা নেই। আমার মনে পড়ে গেল সেই ঝড়বৃষ্টির রাতের কথা। পরিক্ষার আগের রাত বাইরে একটানা ঝড়। ঘরের চালার ফুটো বেঁয়ে অঝরে বৃষ্টির পানি পড়ছে! আমার বইখাতা সব ভিজে যাচ্ছে। 

এগুলো ভাবতেই যেন আমার

আমি একপাশে সব আগলে রেখে পড়ছি। এগুলো ভাবতেই যেন আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।অবশেষে আমার বিয়ে হয়ে গেল।পরিক্ষার সময় আসলে পরিক্ষা হয়ত দিব। এরকম একটা ধোঁয়াশা আশ্বাস দিলেন।আমি গ্রামের মেয়ে শহুরে জীবনে অভ্যস্থ নই।মা বাবাকে ছেড়ে এতদূর প্রথম প্রথম খুব কষ্টই লাগছিল। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। আমি যথাসম্ভব পরিবারের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করি। 

স্বামীর কাজ শাশুড়ির কাজ সংসারের সব দায়িত্ব যেন একা আমার উপর এসে পড়ল। শাশুড়ি অসুস্থ থাকেন প্রায়! কাজের লোক একদিন আসলে ৩ দিন আসে না।ওকে বদলিয়ে নতুন কোন কাজের লোক রাখার মত চিন্তা কারো মনে দেখিনা।আমি নতুন বউ এসব নিয়ে কথা বলতে পারি না।স্বামী চাকরিসূত্রে শহরে বাস করলেও উনাদের গ্রামের যত আত্মীয় আছেন। শহরে উনারা কোন কাজে আসলে বা ডাক্তার দেখাতে আসলে আমাদের বাসায় এসে উঠেন। একে তো সংসারের কাজ শেষ হয় না৷ মোটামুটি মাঝারি ধরনের পরিবার। 

আমার স্বামী দেবর ননদ সহ ৫ জন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে৷ ২ জন দেবর আছে৷ গ্রামের মেহমান আসলে মনে হয় যেন আমি একদম হাঁপিয়ে উঠি। এসে থাকেন কয়েকদিন গরীব ঘরের মেয়ে ছিলাম ঠিক তবে এত কাজকর্ম অভ্যস্থ ছিলাম না কখনো। টুকটাক কাজ রান্নাবান্না ঠিকই পারতাম। কিন্তু এখানে দম ফেলারও যেন সময় ছিল না। গ্রামের আত্মীয় গেলে আমার ননাস ননদরা আসেন পরিবার নিয়ে। উনারা অল্পস্বল্প সাহায্য করলেও দায়িত্ব তো সব আমারই। আমাকেই দেখতে হবে কার কি লাগে।

ঘুড়ি উড়ানোর দৃশ্য দেখতে

হুট করে যখন জানলা দিয়ে অন্যছাদ থেকে ঘুড়ি উড়ানোর দৃশ্য দেখতে পেতাম। মনটা কেমন জানি ছটফট করে উঠত। যেমন খাঁচায় বন্দি পাখির মত। প্রকৃতির কোলে হেসেখেলে বড় হওয়া মেয়ে আমি। এই নতুন জীবনে একদম চুপসে গিয়েছি। আমার স্বামী রাদিনকে যখন কিছু বলতাম বা কিছু আবদার করতাম সে আমার আবদার গুলো বেশির ভাগ সময় বাচ্চামি বলে উড়িয়ে দিত। আমি আঠারোর গন্ডি পেরুইনি আর সে ত্রিশের গন্ডি পেড়িয়ে গেছে আরও ২ বছর আগে! ওর কাছে বউ বলতে ঘর সামলাবে। 

ঘরের সবার খেয়াল রাখবে স্বামীর কথায় কথায় হ্যা-জ্বি/ হ্যা-জ্বি করবে। কিন্তু আমিতো ছিলাম কিশোরী মনা। অফিস থেকে ফেরার পর এক গ্লাস পানি অব্দি সে ঢেলে খায় না। এক গ্লাস পানি থেকে শুরু করে ঘরে পরার সেন্ডেল পর্যন্ত আমাকেই খুঁজে দিতে হয়। না আমি বলছিল না স্বামীর কাজ স্ত্রী করব না অবশ্যই করতে হবে সেটা আমি মানি। ধরেন আমি রান্নাঘরে রান্না করছি ৷ ঘরে মেহমান। সে সোফাতে বসা সামনের ডায়নিং টেবিলেই জগ ভর্তি পানি আর গ্লাস রাখা সে চাইলে পানি ঢেলে খেতে পারে তবুও আমাকে ডাকবে। 

রান্নাঘর থেকে এসে আমি ওকে পানির গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিলেই সে পানি খাবে। প্রথম কদিন আমার স্বামীকে যখন বলতাম সামনেই জগ আর গ্লাস রাখা একটু ঢেলে খেয়ে নাও আমি রান্না বসিয়েছি মাত্র! তখনই পাশের রুম থেকে শাশুড়ী বজ্র কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠতেন। ছেলে সারাদিন বাইরে কাজ করে এসে এখন ঘরেও নিজে নিজে সব করবে? সে বাইরে এত কাজ করে বলেই এই সংসার চলে! আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। হ্যা, তাঁর কাজে মাস শেষে টাকার হিসাব আছে বলে তার কাজের দাম বেশি! এটা 'চাকরি' নামক উপাধি প্রাপ্ত।

কিন্তু গৃহিনী নামক নারীরা

আমার কাজের কোন হিসেব নেই তাই এই কাজ 'কাজ' না। কিন্তু গৃহিনী নামক নারীরা যে বিয়ের মাধ্যমে একটা পার্মানেন্ট চাকরিতে নাম লিখিয়ে দেয় সে হিসাব তো নাই বা বললাম। আজ আমার নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত থাকলে হয়ত এই ঘরে আমার মতামতেরও প্রাধান্য থাকত। নতুন সংসারীতে আমি ইন্টারের নির্বাচনী পরিক্ষা দিতে পারিনি। গ্রামের বাড়ি থেকে হালকা আভাস পেলাম। তখন আমি তিন মাসের অন্তঃস্বত্তা। ঘরের বউ এত পরিক্ষা টরিক্ষার কি দরকার আছে আর! আমার শাশুড়ির মন্তব্য। আমার বুক ফেঁটে কান্না আসছিল। 

হ্যা, আমি তখন বুঝতে পারছিলাম উনারা বিয়েতে কোন দেনাপাওনা চাননি ঠিক তবে তারা যেমন চেয়েছেন তেমন একজন পার্মানেন্ট দাসী রূপী জড়বস্তু ধরে এনেছিলেন ছেলের জন্য। উচ্চ শিক্ষিত সমাজের এই বিকৃত মানসিকতা অনেকটাই আড়ালে থাকে ভদ্রতার লেবাসে। আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুধু মাত্র ফাইনাল পরিক্ষাটা দিতে চাই বলে কোনরকম রাজি করাই। এরপরে আর পড়াশোনার নাম ধরব না। টেস্ট পরিক্ষা না দেওয়ায় টিচারদের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। তবে আমার শারীরিক পরিস্থিতি দেখে উনারা আর কিছু বলেননি আমাকে।


আমার তখন সাত মাস চলছে। ওই অবস্থায় ফাইনাল পরিক্ষা দেই কোনরকম। ওই পরিক্ষায়ই আমার পড়াশোনা জীবনের ইতি টানে। বাবা মা আর কি বলবেন! কিছু বলার নেই। পরের ঘরনী আমি। এই সংসার যুদ্ধে আমার ৮ বছর চলছে এখন৷ ছেলেটার বয়স সাত বছর প্রায়। চার বছরের একটা মেয়েও আছে৷। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না মনে হয়। ২৬ বছরের যুবতী আমি অথচ চেহারায় মনে হচ্ছে ত্রিশ পেরুনো মেয়ে বা তার কাছাকাছি। স্বামী নামক মানুষটা টাকার পিছনে ছুটছে আমার দিকে ফিরে তাকানোর মত সময় তার নেই।

 নিঃস্বঙ্গতা আর একাকিত্ব হয়ত

সুখ দুঃখ, রাগ অভিমানের কোন গল্প আমার নেই। একরাশ নিঃস্বঙ্গতা আর একাকিত্ব হয়ত আমাকে পিষে ফেলত সেখান থেকে আমার দুই সন্তান যেন আমাকে একটু বাঁচার আশা দেখিয়েছে।আমার শাশুড়ি এখন প্রায় বিছানায় সজ্জাশায়ী। উনার দেখভাল করা আমার দায়িত্ব। সেখানে কোন ত্রুটি রাখি না৷আমার শাশুড়ি প্রায় সময় বিছানা নোংরা করে ফেলেন। রাদিন অফিস থেকে আসার পর খাওয়াদাওয়া করে সোফায় বসা। আমি মায়ের রুম পরিষ্কার করছি। সেখান থেকে রাদিন ডাক দিয়ে বললো এক কাপ চা করে দিতে। 

আমি এই মুহূর্তে হুট করে ওকে চা বানিয়ে দেওয়ার মত অবস্থায় ছিলাম না।তারপরেও কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকলেও সজ্ঞানে আছেন। ড্রয়িংরুম আর উনার রুম পাশাপাশি।আমি মিটমিট করে হাসছিলাম। আমার এই হাসির অর্থ আছে৷ এর ৫ মিনিট পরই আমার সাত বছরের বাচ্চা ছেলেটা এককাপ গরম পানি আর গ্রীন-টির প্যাকেট ওর বাবার সামনে ধরে বললো, বাবা টি-প্যাক ঢুবিয়ে দিব। 

রাদিন যেন কেমন ইতস্তত হয়ে গেল!আমি তখন শুধু একটা কথাই বললাম,আমি আমার সন্তানকে সুশিক্ষা দিলে তখন অন্য আরেকজনের সন্তান ঘরে আসলে সে একটু হলেও সুখে থাকবে।দোষ প্রথমেই সন্তানের থাকে না থাকে পিতামাতার।আট বছর পর এই কথাগুলো বলে যেন একটু শান্তি পেলাম। অন্যরকম শান্তি।যেন বুকের ভিতর কষ্টের উত্তপ্ত গলিত লাভা একটু শীতলতা পেল।